কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আমড়াতলীর আছিয়া বেগম একজন কৃষিশ্রমিক। অন্যের জমিতে দিনমজুরির কাজ করেন তিনি। বয়স ৪৪ ছুঁই ছুঁই। বছর দুয়েক আগে বাম চোখে আবছা দেখতে শুরু করেন।
কিছুদিন পরে দেখা যায়, ছানির হলুদাভ থাবা ঘিরে নিচ্ছে পুরো চোখ। কিন্তু টাকার অভাবে অপারেশন করতে পারছিলেন না। তার স্বামী ইয়াকুব আলী বলেন, ‘কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিচ্ছিলাম আমার স্ত্রীর অপারেশনের জন্য। কিন্তু টাকার অঙ্ক শুনে আমরা পিছিয়ে আসতাম।
গত মাসে আমড়াতলী চেরাগ আলী উচ্চবিদ্যালয়ে ফ্রি চক্ষুসেবা ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। সেখানে আছিয়াকে দেখালে তারা জানান, ছানি অপারেশন করতে হবে।
গত সপ্তাহে বসুন্ধরা আই হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট আছিয়াকে বিনামূল্যে অপারেশন করে দিয়েছে। তারা এগিয়ে না এলে আমার স্ত্রীর চোখের আলো হয়তো নিভে যেত। এই উপকারের বিনিময়ে দোয়া ছাড়া আমাদের আর দেওয়ার মতো কিছু নেই।
শুধু আছিয়া নন
, গত ১০ বছরে ছানি; নেত্রনালিসহ চোখের বিভিন্ন সমস্যায় বিনামূল্যে ২ হাজার ৬৯০ জনের অপারেশন করেছে বসুন্ধরা আই হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকে এই হাসপাতালের অবস্থান। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ৪৯টি আই ক্যাম্পে সেবা দিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ বিনামূল্যে সেবা পেয়েছে হাসপাতাল থেকে।
বসুন্ধরা চক্ষু হাসপাতালের সার্বিক পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও ভিশন আই কেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সালেহ আহমেদ। হাসপাতাল তৈরির স্বপ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মায়ের চোখে সমস্যা ছিল।
কিন্তু ভাল্বে সমস্যা থাকায় চিকিৎসকরা চোখের অপারেশনের ঝুঁকি নিতে পারছিলেন না। এক সময় মায়ের চোখের আলো নিভে যায়। আমি তখন মেডিক্যালে চতুর্থ বর্ষে পড়ি। তখন থেকেই স্বপ্ন একটা হাসপাতাল করার, যেন চোখের রোগ কারও আশার আলো নিভিয়ে না দিতে পারে। কেউ যেন অর্থের জন্য সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়।
সেই স্বপ্নকে সফল করতে আমি একটু একটু করে টাকা জমাতে শুরু করি। ২০১০ সালে হাসপাতালের জন্য জমি দেখতে শুরু করি। এ সময় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান আমার এ পরিকল্পনা জানতে পেরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় জমি দেন হাসপাতাল গড়ে তোলার জন্য। তৈরি করে দেন হাসপাতালের অবকাঠামো।
হাসপাতালের জন্য অনুদান দিয়ে স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেন। বসুন্ধরা গ্রুপ এবং ভিশন কেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রচেষ্টায় দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে থাকে চোখের সেবা।’ তিনি আরো বলেন, ‘দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে আমরা হতদরিদ্র মানুষকে সেবা দিয়েছি।
অপারেশনের পরে যখন দৃষ্টি ফিরে আসে তখন রোগীর হাসিমুখ দেখাটাই আমাদের নির্মল আনন্দ। মানুষ যখন মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে, কৃতজ্ঞতায় যখন তাদের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে তখন আমাদের হৃদয় সিক্ত হয়। চিকিৎসক হিসেবে এর চেয়ে বেশি আর কী পাওয়ার থাকতে পারে।
দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো ও আধুনিক কারিগরি ব্যবস্থাপনায় তৈরি হাসপাতালটি চালু হয় ২০১৪ সালে। ১০ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালটি। বসুন্ধরার এই চক্ষু হাসপাতাল দেশের অন্যান্য চক্ষু হাসপাতাল থেকে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমী।
এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসার পাশাপাশি স্বল্পমূল্যে এবং বিত্তবানদের জন্য সামান্য বেশি মূল্যে একই মানের চিকিৎসা দেওয়া হয়। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে দরিদ্র যে কেউই এখানে এসে চিকিৎসাসুবিধা নিতে পারেন।
মুসলমানদের জন্য আছে জাকাত ফান্ড; যা সম্পূর্ণ শরিয়াহভিত্তিক। অন্যান্য ধর্মের মানুষের জন্যও ফান্ড আছে। দরিদ্র রোগীদের আধুনিক ও উন্নতমানের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি বিনামূল্যে ওষুধ ও চশমা দেওয়া হয় এবং ইনভেস্টিগেশন ও অপারেশন করা হয়।
বসুন্ধরা আই হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফাইজা রহমান বলেন, সাধারণ বহির্বিভাগে সকাল ৮টা ৩০ থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ৪০০ টাকা ফি দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন রোগীরা।
বহির্বিভাগের প্রাইভেট সেকশনে দেখাতে চাইলে ফি ১ হাজার ৬০০ টাকা। এই হাসপাতালে সামর্থ্য অনুযায়ী রোগীরা তাদের পছন্দে যে কোনো ওপিডিতে সেবা নিতে পারেন। কিন্তু সেবার মানে কোনো পার্থক্য নেই।