
কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সবেমাত্র স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন জান্নাতুল জেসমিন। এই বয়সে যখন ছেলে-মেয়েদের সময় কাটে শুধু পড়াশোনা আড্ডা আর গল্পে, তখন জেসমিন ব্যস্ত ভিন্ন এক কাজে। পড়ালেখার পাশাপাশি অবসর সময় তার কাটে সুই-সুতো হাতে। জিন্স প্যান্ট কেটে তার ওপর নকশা তুলে সেটিকে ব্যাগে রূপান্তর করেন দারুণ সব ডিজাইনে। এরইমধ্যেই তার এই কাজ প্রশংসিত হয়েছে দেশ-বিদেশে। এই বয়সেই তিনি মাসে আয় করছেন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। বার্ষিক আয় সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার মতো।
ছোটবেলা থেকেই আঁকাআকি করতেন জেসমিন। সুই-সুতোর কাজগুলোও কিছুটা আয়ত্ত করেছিলেন মায়ের কাছ থেকে। বানাতেন ব্যাগসহ টুকটাক নানান কিছু। তবে এইচএসসি পরীক্ষার পর তার বানানো ডেনিমের ব্যাগ বিক্রি হতে শুরু করে। শখ করে বানানো ব্যাগ, চুলের ক্লিপ ও মাস্ক ঘুরিয়ে দিয়েছে তার জীবনের মোড়।
দেশ-বিদেশ মিলে মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার ব্যাগ বিক্রি হয় জেসমিনের। এরমধ্যে বিদেশে যাচ্ছে ২৫ শতাংশ। সাউথ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, জার্মানি, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যমহ ১৫টি দেশে পৌঁছে গেছে তার ব্যাগ।
কিন্তু শুধু জিন্সের প্যান্ট কেটেই কেন ব্যাগ বানাতে হবে? কম খরচে জিন্স কাপড় কিনেওতো বানানো যায়। এমন প্রশ্নের উত্তরে জেসমিন জানালেন, জিন্স প্যান্টই তার ব্যাগের প্রধান বিশেষত্ব।
তিনি বলেন, আমি যখন কোথাও যাই, সবাই দেখে বলে আরে এটাতো একটা প্যান্ট! প্যান্ট কীভাবে ব্যাগ হয়ে গেল? এই বিষয়টি আমি খুব উপভোগ করি। অর্থাৎ, এটার যে একটা ইউনিকনেস আছে, সেটি ধরে রাখতেই আমি নতুন প্যান্ট বাজার থেকে কিনে নিয়ে এসে সেটি কেটে ব্যাগে রূপান্তর করি। প্রতিটি প্যান্ট কিনতে আমার ৬০০ থেকে ৭০০ থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। যদিও এর চেয়ে অনেক কম টাকা দিয়ে আমি জিন্স কাপড় কিনেও ব্যাগ বানাতে পারতাম। কিন্তু সেখানে কোনো ভিন্নতা থাকতো না।
১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে তার প্রতিটি ব্যাগ বিক্রি হয় জানিয়ে তিনি বলেন, একেকটি ব্যাগ তৈরিতে তার খরচ হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা। ব্যাগসহ তিনি নকশা তুলেন জুতা, মাস্ক, হেয়ার বো, ব্র্যান্ড এবং ক্লিপসে।
মায়ের অনুপ্রেরণা আর সহযোগিতা জেসমিনকে করে তুলেছে স্বাবলম্বী। তার মা সুলতানা আবেদিন বলেন, ‘আমার ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল নিজে একটা কিছু করার। কিন্তু পড়ালেখা এবং পরবর্তীতে সাংসারিক নানা ঝামেলায় তেমন কিছু করতে পারিনি। আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকে আমার হাতের কাজগুলো দেখতো। সেখান থেকেই তার এসব কাজের প্রতি কিছুটা আগ্রহ তৈরি হয়। এখন ও সবকিছু বুঝে, কোনটা কিভাবে করতে হয় সব তার ধারণা আছে। সব ডিজাইন তার করা। আমি শুধু তাকে কাটিংয়ের কাজে কিছুটা সহযোগিতা করি। আমার মেয়ের স্বপ্ন আমার স্বপ্ন এক। আমি চাই সে অনেক দূর এগিয়ে যাক।’
ভবিষ্যতে মেয়ের জন্য একটি কারখানা ও শো-রুম করে দেয়ার স্বপ্ন বাবার। বাবা মো. জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘আমার মেয়ের ব্যাগ আমি নিজে ডেলিভারি দিয়ে আসি। ক্রেতাদের কাছে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করি যে পণ্যগুলো তারা কিভাবে নিচ্ছে। পরে দেখি তারা খুব খুশি হয়, প্রশংসা করে। তখন আমার খুবই ভালো লাগে। গর্বের সঙ্গে বলতে পারি এটি আমার মেয়ের কাজ। আমি চাই আমার মেয়ে আরও এগিয়ে যাক। বাবা হিসেবে তার স্বপ্ন পুরণের জন্য একটি শোরুম করে দিতে চাই।’
পড়ালেখা শেষ করে অনেকেরই লক্ষ্য থাকে ভালো কোনো চাকরি করার। তবে জেসমিনের স্বপ্ন ভবিষ্যতে একজন বড় উদ্যোক্তা হওয়া। থাকবে নিজস্ব কারখানা এবং শো-রুম। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে তার কাজ- এমনটিই প্রত্যাশা তার।