স্ক্রাপ সিন্ডিকেটের হস্তক্ষেপ রডের বাজারে

আন্তর্জাতিক বাজারে পুরাতন জাহাজের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে স্ক্রাপের দামও বেড়ে যায়। পুরোনো জাহাজ ক্রয় ৫৮০ থেকে ছয়শো ডলার প্রতি টনে খরচ পড়তো।

এই দামে পুরোনো জাহাজ কিনে দেশে এনে ভেঙে স্ক্রাপ বিক্রি করতে হচ্ছিলো প্রতি টন ৭২ হাজার টাকায়। কিন্তু গত কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক বাজারে লোহার দাম কমতে শুরু করলেও, দেশের বাজারে স্ক্রাপ জাহাজের দাম কমাই নি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো৷ গত ১৩ ই সেপ্টেম্বর থেকে স্ক্রাপ বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সীতাকুণ্ডের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোকে।

ফলে রি রোলিং মিলগুলো স্ক্রাপ সংকটের কারণে উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছেন৷ আন্তর্জাতিক বাজারে রডের দাম কমলেও দেশের বাজারে বাড়ার আশংকা করছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকদের মতে,

৭২ হাজার টাকার স্ক্রাপ (টন) বর্তমানে ৫৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে রি রোলিং মিলগুলো। এই দামে স্ক্রাপ বিক্রি করতে হলে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকদের কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে। এই কারনে স্ক্রাপ বিক্রি বর্তমানে বন্ধ রাখা হয়েছে – এমন যুক্তি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকদের।

স্টিল স্ক্রাপ বায়ার এসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ মনির হোসেন জানান, ‘ পূর্ব ঘোষণা ব্যাতিত সবকটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে স্ক্রাপ বিক্রি বন্ধ করে দেবার কারণে রডের বাজারে এমন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। রি রোলিং মিলগুলো স্ক্রাপ সংকটের কারণে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারছে না। এতে করে স্ক্রাপ নির্ভর রি রোলিং মিলগুলি বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। ‘

খাত সংশ্লিষ্টদের মত,অযাচিত সিদ্ধান্তের কারণে এই খাতে দুই লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হতে বসেছে।ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার পরেও দেশের বাজারে ভোক্তারা কম খরচে নির্মাণের সুযোগ হারাচ্ছেন।

দেশে বর্ষায় সাধারণত নির্মাণ কাজে ধীরগতি থাকে। এ কারণে রডের চাহিদা কমে যায়। আর চাহিদা কমে যাওয়ায় গ্রেড ৬০ এর এমএস রডের দাম কিছুটা কমেছে।গত বৃহস্পতিবার থেকে দাম কমেছে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে উৎপাদন ব্যাহত হলে রডের দাম আবারও বৃদ্ধি পেতে পারে।

চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা কারখানায় দুই শ্রমিকের প্রাণহানি

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, বৃহস্পতিবার প্রতি টন রডের দাম ছিল সাড়ে ৯৯ হাজার টাকা। এটি আগে ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৫০০ টাকা। চলতি সপ্তাহে রডের উৎপাদন কমে আসার আশংকা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (বিএসআরএম) উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে রডের চাহিদা কমে গেছে। কিন্তু স্ক্রাপ সংকটের কারণে উৎপাদনও প্রভাবিত হচ্ছে।

উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় রডের দাম বাড়ানো হতে পারে বলে উৎপাদকেরা জানিয়েছেন।

তাঁদের তথ্য অনুযায়ী,

জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে গ্যাস–বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি মূল্য পরিশোধ, তুরস্কের ভূমিকম্পের পর বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম আরেক দফা বৃদ্ধির কারণে রডের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাতে গ্যাস–বিদ্যুৎ ও ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তার কাঁধে এসে পড়েছে।

এরআগে রড উৎপাদনে খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তা সমন্বয় করা হয়েছিলো। শুধু জাহাজভাঙা শিল্পের স্ক্র্যাপ (পুরোনো লোহার টুকরো) ব্যবহার করে রড উৎপাদন করলে উৎপাদন খরচ কমার কথা। কিন্তু স্ক্রাপ বিক্রি বন্ধ করে দেবার কারণে বাজারে রডের সংকট তৈরি হবে।

তবে খাত সংশ্লিষ্ট বলছেন ‘বর্ষা শুরু হওয়ায় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রকল্পসহ সব নির্মাণ কাজ ধীরগতিতে চলছে। এ কারণে উৎপাদনকারীরা রডের দাম কমিয়েছিলেন। কিন্তু শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো স্ক্রাপ বিক্রি বন্ধ রাখার কারণে রড উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানিয়েছেন, মাত্র ৪ মাস আগেও এমএস রডসহ অন্যান্য প্রধান নির্মাণ সামগ্রীর দাম ঘন ঘন বাড়ছিল। এখন উন্নয়ন কাজে ধীর গতির কারণে অনেক শ্রমিককে কাজ হারাতে হচ্ছে।

শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকরা জানিয়েছেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালের সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আসে আরেকটি ধাক্কা।

ফলে জাহাজভাঙা শিল্পের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ জাহাজের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। এখন লোহার দাম কমেছে ঠিক, কিন্তু বাড়তি দামে কেনা স্ক্যাপ জাহাজ থেকে কম দামে স্ক্রাপ বিক্রি রীতিমতো অসম্ভব।

ডলার ব্যবস্থাপনায় কড়াকড়িতে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি কম

জানা যায়, ২০২২ সালের শেষদিকে কাঁচামালের দাম কিছুটা কমে আসে। তবে তখন দেশের ব্যাংক খাতে ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী স্ক্র্যাপ আমদানি করতে পারেনি ইয়ার্ড মালিকরা। ফলে কাঁচামাল সংকটে বেশিরভাগ ইয়ার্ডের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব ইয়ার্ড ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তাদের সামনেও কঠিন চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) তথ্যমতে,

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলে ১৬০টি শিপ ইয়ার্ড রয়েছে। এরমধ্যে ২০১২ সালের পর থেকে বন্ধ হতে হতে ২০১৯ সালে এসে ইয়ার্ডের সংখ্যা ৯০টিতে নেমে আসে।

২০১২ সালের পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে দামের উত্থান-পতন, চাহিদার চেয়ে বাড়তি আমদানি, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আবাসন ব্যবসার মন্দায় লোকসানে পড়ে এসব ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যায়।করোনা-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে প্রায় ৩০টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

সর্বশেষ ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় আরো ৪০ ইয়ার্ডের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ২০ থেকে ২২টি ইয়ার্ড কোনোরকমে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

এসব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের মালিকরা স্কাপের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে রি রোলিং মিলগুলোকে ধংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে এমন অভিযোগ রড ও ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের।