ব্যাংকের ১১ হাজার শাখাই অনলাইন সেবার আওতায়

ব্যাংকিং লেনদেনে প্রযুক্তিনির্ভরতা দিন দিন বেড়ে চলছে। কয়েক বছর আগেও মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, চেক দিয়ে লেনদেন করা, এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে স্বাক্ষরের জন্য ফাইল যাওয়াÑব্যাংকের এমন ধারায় অভ্যস্ত ছিল। বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বাড়ার ফলে মানুষের হাতের মুঠোয় ব্যাংকের সেবা চলে এসেছে। প্রযুক্তিনির্ভর সেবা এতটাই ছড়িয়ে পড়ছে যে গত বছর বাংলাদেশের মোট ব্যাংক শাখার প্রায় ১০০ শতাংশ অনলাইন ব্যাংকিং সেবা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট, ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ৬১ ব্যাংকের ব্রাঞ্চসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ১৩৯টি। এর মধ্যে ১১ হাজার ১৩৮টি ব্রাঞ্চ অনলাইন ব্যাংকিং সেবা প্রদান করেছে, যা মোট শাখার ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ব্যাংকগুলো এটিএম বুথ, পয়েন্ট অব সেলস বা পিওএস যন্ত্র, ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন (সিআরএম), ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও বিভিন্ন ধরনের কার্ডের মাধ্যমে অনলাইন ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

এটিএমের মাধ্যমে কার্ড লেনদেন: ২০২২ সালে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডে অস্বাভাবিক লেনদেন বেড়েছে। ২০২২ সালে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে যে লেনদেন হয়েছে, তা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে ক্রেডিট কার্ডে ২৮ হাজার ৯০৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ২০২১ সালে এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ১০৭ কোটি, ২০২০ সালে ১৪ হাজার ২৪৬ কোটি, ২০১৯ সালে ১৮ হাজার ৯২৯ কোটি এবং ২০১৮ সালে ১৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা।

অপরদিকে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে ২০২২ সালে তিন লাখ ৩৮ হাজার ৭০১ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ২০২১ সালে লেনদেনের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৯ কোটি, ২০২০ সালে এক লাখ ৭৭ হাজার ৩৫ কোটি, ২০১৯ সালে এক লাখ ৬৭ হাজার ১২৩ কোটি এবং ২০১৮ সালে এক লাখ ৪২ হাজার ৪৬ কোটি টাকা।

কার্ডে লেনদেনের জন্য দেশে এটিএম বুথ রয়েছে ১৩ হাজার ৪৩৪টি। গত বছর এটিএমের মাধ্যমে রেকর্ড লেনদেন হয়েছে। তিন লাখ ৭৪ হাজার ৪০৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ২০২১ সালে এটিএমের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল দুই লাখ ২৮ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এক লাখ ৬৮ হাজার ৩২ কোটি, ২০১৯ সালে এক লাখ ৬২ হাজার ৯৯৫ কোটি এবং ২০১৮ সালে এক লাখ ৩৮ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।

ইন্টারনেট ব্যাংকিং লেনদেন ঊর্ধ্বমুখী: দেশের অনেকেই এখন বিভিন্ন আর্থিক সেবা পেতে কম্পিউটার ও মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করছে। গত বছর ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে । ২০২১ সালে এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৭ হাজার ৩৮৪ কোটি, ২০২০ সালে ছিল ৭৯ হাজার ৮০৪ কোটি, ২০১৯ সালে ৬৫ হাজার ৮৮৪ কোটি এবং ২০১৮ সালে ৩২ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা।

মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস): দেশে আর্থিক সেবায় বড় বিপ্লব এনেছে মোবাইলে আর্থিক সেবা বা এমএফএস। এর ফলে বিকাশ, রকেট, নগদ ও উপায়ের মতো ১৩টি এমএফএস প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গ্রাহকেরা সহজেই হিসাব খুলতে পারছেন। আর টাকা স্থানান্তর করা যাচ্ছে কয়েক সেকেন্ডে। এমএফএসের আওতায় রয়েছে ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তরের সুবিধাও। আবার এখন সঞ্চয়ের পাশাপাশি ঋণও মিলছে এ সেবায়। বিভিন্ন পরিষেবা ও কেনাকাটার বিল পরিশোধ, মুঠোফোনে রিচার্জ এবং কাউকে টাকা পাঠানোসহ নানা লেনদেনও করা যাচ্ছে ঘরে বসে। গ্রাহকেরা ঘরে বসেই ডিজিটাল কেওয়াইসি (গ্রাহক সম্পর্কিত তথ্য) ফরম পূরণ করে হিসাব খুলতে পারছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শেষে এসব সেবায় নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১৯ কোটি আট লাখ। আর সেবা দিতে সারা দেশে এমএফএস এজেন্ট রয়েছে ১৫ লাখ ৬০ হাজার জন। গত বছর এই সেবার মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ১০ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। আগের বছর এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৭০১ কোটি টাকা। বিভিন্ন সেবার পাশাপাশি এখন এমএফএসের মাধ্যমে বৈধভাবে প্রবাসী আয়ও বিতরণ হচ্ছে।

এজেন্ট ব্যাংকিং: বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হয়। বাংলাদেশে এ সেবা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ২০১৪ সালে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে। এরপর এ সেবার বিস্তৃতি শুরু হয়। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার আওতায় ইউনিয়ন পর্যায়ে পাওয়া যাচ্ছে ব্যাংকিং সেবা, স্কুলেও বসেছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় দেয়া ভাতাও গ্রামগঞ্জে সহজে পাওয়া যাচ্ছে এজেন্টদের মাধ্যমে। বর্তমানে জনপ্রিয় হচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা। এ সেবার মাধ্যমে গত বছর সবচেয়ে বেশি লেনদেন করেছে গ্রাহকরা।

গত বছর শেষে দেশে ৩১টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। সারা দেশে প্রায় ২০ হাজার ৮৩৬টি এজেন্ট আউটলেট রয়েছে। গত বছর শেষে এসব এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার আওতায় ব্যাংকে আমানত এসেছে ২৯ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। করোনাকালে ব্যাংক শাখা বন্ধ থাকায় এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

২০১৫ সালে স্থাপিত রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্টের (আরটিজিএস) মাধ্যমে গত বছর ৫১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশ অটোমেটেড চেক ক্লিয়ারিং হাউস (বিএসিএইচ) থেকে পরিশোধ হাই ভ্যালু পরিশোধ হয়েছে ১৬ হাজার ১১০ কোটি আর রেগুলার ১০ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এছাড়া ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (ইএফটিএন) এবং ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইসের (এনপিএস) মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক লেনদেন হচ্ছে।

ক্যাশলেস লেনদেনে বাংলা কিউআর: ক্যাশলেস লেনদেনে মানুষকে অভ্যস্ত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম বাংলা কিউআর। ২০২৭ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ লেনদেন ক্যাশলেস করতে ‘বাংলা কিউআর’ নামে আন্তঃব্যাংক কোডভিত্তিক লেনদেন ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন উপায়ে উদ্বুদ্ধ করার পরও অর্ধেক ব্যাংকই এ ব্যবস্থায় যুক্ত হয়নি। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৮টি ব্যাংক ও ৫টি এমএফএস নিজেদের অ্যাপে বাংলা কিউআর যুক্ত করেছে। যুক্ত না হওয়া ব্যাংক ও এমএফএসের প্রতিনিধিদের নিয়ে গতকাল বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোমবার বৈঠকে এসব প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত যুক্ত হওয়ার তাগিদ দেয়া হয়।

দেশে বর্তমানে ৬১টি ব্যাংক এবং ১৩টি এমএফএস রয়েছে। বাংলা কিউআর হলোÑদেশের সব ব্যাংক ও এমএফএসের অ্যাপভিত্তিক লেনদেন নিষ্পত্তির একটি সাধারণ প্লাটফর্ম। যে কোনো দোকানে এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত যে কোনো ব্যাংক বা এমএফএসের কিউআর থাকলেই অন্য ব্যাংক, এমএফএসের গ্রাহক পরিশোধ করতে পারবেন। লেনদেনে স্বচ্ছতা বাড়ানো, ঝুঁকিমুক্ত করা, কম খরচ ও দ্রুত করতে ক্যাশলেস লেনদেনের প্রচারণা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে, কিছু ব্যাংক ও এমএফএসের অ্যাপ থাকলেও তারা যুক্ত হচ্ছে না। আর কিছু ব্যাংকে এখনও অ্যাপ নেই। এসব ব্যাংক যেন দ্রুত অ্যাপ চালু করে বাংলা কিউআরে যুক্ত হয় সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ক্যাশলেস লেনদেনে অনেক ব্যাংক অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অনেক ব্যাংক এখনও বাকি রয়েছে। তাদের সঙ্গে সভা হয়েছে। তারা কবে এবং কীভাবে চালু করতে পারে এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা জানা হয়েছে।