কর্ণফুলী নদীর দুঃখ ‘কালুরঘাট’

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ও জীববৈচিত্র্য ধংসের জন্য সবচেয়ে ধংসাত্নক ভূমিকা রাখছে এই অঞ্চলে গড়ে উঠা বৈধ, অবৈধ বালুর মহাল। দীর্ঘদিন থেকে কালুরঘাট সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে নির্বাচারে বালু তুলে বিক্রি করছে একটি চক্র।

কালুরঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন বালু খেকো মনসুর আলম পাপ্পী সিন্ডিকেট। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, প্রতিদিন ড্রেজার দিয়ে কর্ণফুলী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর ভাঙন বৃদ্ধি পেয়ে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কর্ণফুলীর নদীর ভাঙনে এলাকার শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কর্ণফুলী নদীর ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া বালুর বস্তা ও ব্লক নদীতে মিশে যাচ্ছে।

বালু উত্তোলন করার পর কর্ণফুলী নদীর তীরে বিশাল পাহাড়ের মতো স্তুপ করে রাখা হয়৷এই বালু খেকোরা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে কোনো ইজারা না নিয়ে এভাবে বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে।এতে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমান রাজস্ব আয়, ধংসের দ্বারপ্রান্তে কর্ণফুলী নদী।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হালদা ও কর্ণফুলী নদীর সংযোগস্থল কালুরঘাট পয়েন্টে গত আট বছরে ছয়বার বিপদসীমা অতিক্রম করেছে পানির উচ্চতা। ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৯৮ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় পানির উচ্চতা।

বিশেষজ্ঞদের মতে কর্ণফুলী নদীর বন্দর শাসিত এলাকা হালদা মোহনা থেকে কর্ণফুলী মোহনা পর্যন্ত ১০ মাইল কর্ণফুলী রক্ষায় ২০১৪ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তপক্ষ “স্ট্রাটেজিক মাস্টার প্ল্যান ফর চিটাগাং পোর্ট” শীর্ষক একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিএস জরিপ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ঠিক রেখেই সেই পরিকল্পনা করা হয়। বন্দরের স্বাভাবিক গতিশীলতা ও কর্ণফুলীর নাব্যতা রক্ষায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প নাই। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশী মতো নদী লিজ দিয়ে কর্ণফুলী নদীর সর্বনাশ করছে।

কালুরঘাটের বিভিন্ন বিভিন্ন স্থানে চলছে বেপরোয়া বালু উত্তোলন। এর ফলে অনেক বড় বড় স্থাপনা ও সড়ক-মহাসড়ক হুমকির মুখে পড়ছে। অবৈধ বালু উত্তোলনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ব্যাপকভাবে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী ও নদীর তীরবর্তী জনগণ। নদীর ভাঙন রোধে সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। এ অবস্থায় অপরিকল্পিত ও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে সরকারের কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওয়াহিদুল আলম বলেন, “প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সারা বিশ্বে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। এ কারণে হালদা ও কর্ণফুলীতে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে লবণাক্ততা। পরিবর্তন আসছে এ দুই নদীর জীববৈচিত্রেও। লবণের কারণে মা মাছ তার চিরায়ত প্রজনন ক্ষেত্র হারিয়ে উজানের দিকে চলে যাচ্ছে।

নদী সুরক্ষার জন্য সুইপিং করে নিয়ম মাফিক বালু উত্তোলন করার কথা থাকলেও বর্তমানে ইচ্ছেমতো স্থানীয় ড্রেজার লাগানো হয়েছে।

ড. মন্জুর আহমেদ চৌধুরী, চেয়ারম্যান, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন

কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা বালির সেলস সেন্টার ও অবাঞ্ছিত স্থাপনা সরানোর নানা উদ্দ্যেগ কাজ আসে নি। তিন বছরের জন্য নতুন করে ফেরি ঘাট ইজারা দেয়া হয়েছে একই চক্রের কাছে। জানতে চাইলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মন্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ নদী সুরক্ষার জন্য সুইপিং করে নিয়ম মাফিক বালু উত্তোলন করার কথা থাকলেও বর্তমানে ইচ্ছেমতো স্থানীয় ড্রেজার লাগানো হয়েছে। কর্ণফুলীর তীর দখলের অন্যতম কারণ নির্বিচারে বালির মহাল ইজারা দেয়া। ‘

স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, সামান্য খরচে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে তা অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। এমন লাভের কারণে বালু দস্যুরা বিশেষ কৌশলে বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে কালুরঘাটের বিভিন্ন প্রান্তে বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে।