ঋণ পরিশোধের বাড়তি চাপ ডলারে

দেশের বাজারে তীব্র ডলার সংকটকে তীব্রতর করেছে বেসরকারি খাতে নেয়া স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধের জন্য ডলারের বাড়তি চাহিদা। স্বল্প সুদে দেশের বাইরের বিভিন্ন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর ঋন পরিশোধের তাগাদা আরেকদফা ডলার সংকটকে উসকে দিয়েছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে এখনও পর্যন্ত  মুখ খোলেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

দেশে চলমান ডলারের সংকটের এক বছর অতিবাহিত হয়েছে ইতিমধ্যে । কিন্তু  বৈদেশিক লেনদেনের প্রধান এ মুদ্রা নিয়ে অস্থিরতা কমেনি। খোলাবাজারে ডলার মিলছে না,  ব্যাংকেও পর্যাপ্ত ডলার নেই। ইতোমধ্যে ডলারের বিপরীতে  টাকার ২৫ শতাংশ ডিভ্যালুয়েশন (অবমূল্যায়ন) হয়েছে। ডলার সংকট আরও বেড়ে যাবার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মতে,  বিশ্ববাজারে ডলারের মূ্ল্যের যে বড় উল্লম্ফন, সেটি ডলার সংকটকে উসকে দিয়েছে। বিশ্ববাজারের এই শকটা বড় আকারের ছিল। ব্যালেন্স অফ পেমেন্টেও ছিল, মূল্যস্ফীতিতেও ছিল। আর সে জন্য দেশের অর্থনীতি  বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সাধারণত বাণিজ্যিক আমদানির দেনা ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যাংকগুলো আগাম বা ফরোয়ার্ড ডলার কিনে রাখে। বাণিজ্যিক পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি আমদানিতেও এখন ভরসা এই আগাম কেনা ডলার, যার বেশিরভাগই ব্যবহৃত হচ্ছে আমদানির দেনা পরিশোধে। কিন্তু আগাম কিনে না রাখার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে অফসোর ব্যাংকিংয়ের  ঋন পরিশোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ডলার মিলছে বাজারে।

অফসোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অতিরিক্ত ডলার খোয়াতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। পাঁচ বছর আগে ঋণ সংগ্রহ করার সময় ডলারের দাশ ছিলো আশি টাকা, আর পরিশোধ করতে হচ্ছে ডলার প্রতি অন্তত  ত্রিশ টাকা বেশি। শত কোটি টাকার বেশি ঋণ নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো  একশো দশ টাকা দামে ডলার কেনে ( আশি টাকার জায়গায়) পরিশোধ করতে হচ্ছে সেসব ঋণ। ফলে স্বল্প সুদের ঋণ ব্যবহারের আশায় পুরোটায় গুঁড়েবালি। সুত্রমতে, ২/৩ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ সংগ্রহ করে  টাকার অংকের অফসোর ব্যাংকিংয়ের সেসব ঋণের সুদ ক্ষেত্রবিশেষে পনের শতাংশের বেশি পড়ছে।

এদিকে, ডলারের সংকটের কারণে  আমদানি পণ্যের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বাজারে এসব আমদানিকৃত পণ্যের দামও বাড়ছে। আবার অন্যান্য পণ্যের দামেও এর প্রভাব পড়ছে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়ছে। বিভিন্ন মেয়াদে আগাম ডলার এখন বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে ১১৩ টাকা ৮৫ পয়সায়। কোনো কোনো ব্যাংক ১১৪ টাকা করেও বিক্রি করছে। জানা গেছে, ব্যাংকে বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দামে আমদানির ডলার মিলছে না। এমনকি আন্তঃব্যাংকেও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই চড়া দামে এক মাস থেকে এক বছরের আগাম ডলার কিনে রাখতে হচ্ছে আমদানিকারকদের।

এদিকে, গেল অগাস্ট মাসে রেমিটেন্স কমেছে ২১ শতাংশ, যা গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এটি বৈদেশিক মুদ্রার কমতে থাকা রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বলা হচ্ছে  শুধু বিনিময় হারের অস্বাভাবিক আচরণের কারণে ব্যাংকগুলোয় ঝুঁকির মাত্রা ২৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। এই খাতে আগে এত ঝুঁকি ছিল না। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ডলারের প্রবাহ বেশি ছিল ও ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্যের প্রবাহ ছিল। ডলার সংকটের ঝড়ে সবকিছুই যেন হারানো  অতীত।

বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোতে আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম ১১০ টাকা হলেও খোলাবাজারে তা ১১৭-১১৮ টাকায় উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে আগের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী, রোগী ও পর্যটক বিদেশে যাওয়ায় নগদ ডলারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন মুদ্রাটির দাম বেড়ে গেছে। এ জন্য দায়ী বিভিন্ন মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করার পাশাপাশি ব্যাখ্যাও তলব করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে বেশি দামে ডলার বিক্রি করায় কিছু ব্যাংকেরও ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলারের সংকট সমাধানে এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার সবই অস্থায়ী ভিত্তিতে। সংকট কমবে, এমন কোনো কার্যকর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। ডলার-সংকটের জন্য যাঁরা দায়ী, বিশেষত অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে। এটা না করে উল্টো বেশি দামে ডলার কেনা-বেচা করায় ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা সংকট আরও উসকে দিচ্ছে। ফলে গত আগস্টে প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের পতন হয়েছে।