দেশে ডিটারজেন্টের পেছনে খরচ ১৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা

২০২০ সালে এক বছরে দেশে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যবিধি বা ওয়াশ ব্যয় ছিল ৫৯ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। মোট জিডিপির যা ২ দশমিক ১৮ শতাংশ। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির কথা বিবেচনায় সাবান ও ডিটারজেন্ট সংগ্রহের জন্য ব্যয় করেছে ১৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

রবিবার (২৯ অক্টোবর) দেশের প্রথম ‘ন্যাশনাল ওয়াশ অ্যাকাউন্টস’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, খানাপ্রতি বার্ষিক গড় ওয়াশ ব্যয় সাড়ে ১১ হাজার টাকা। খানার বার্ষিক আয়ের যা ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে পানির জন্য এক হাজার ৫০২, পয়ঃনিষ্কাশনে এক হাজার ৯৮৫ এবং স্বাস্থ্যবিধিতে ব্যয় হয় আট হাজার ৮৭ টাকা। আয়ের পরিমাণ অনুসারে খানার ওয়াশ ব্যয় হিসাব বলছে, শহর-গ্রাম উভয়ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও অতিদরিদ্র খানাগুলোতে ওয়াশ ব্যয়ের হার সবচেয়ে বেশি।

প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন, এনডিসি, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী।

দেশে ডিটারজেন্টের পেছনে খরচ ১৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন ওয়াটারএইড দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক পরিচালক ড. খায়রুল ইসলাম এবং ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান। ন্যাশনাল ওয়াশ অ্যাকাউন্টস প্রণয়ন কার্যক্রমের ফোকাল পয়েন্ট ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো উপপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন ‘ন্যাশনাল ওয়াশ অ্যাকাউন্টস’ প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন।

২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবসান, সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য, জেন্ডার সমতা, জলবায়ু, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা, শোভন কর্মসংস্থান এবং গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি এসডিজি ৬ অর্জনে সকলের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের প্রাপ্যতা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি (ওয়াশ) খাতে অগ্রগতি অর্জনে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

পরিকল্পনামন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের অংশ হিসেবে নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) খাতে তথ্য-প্রমাণভিত্তিক পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণের পাশাপাশি ওয়াশ খাতে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো নিয়মিতভাবে ‘ন্যাশনাল ওয়াশ অ্যাকাউন্টস’ হালনাগাদ কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।

পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন এই তিনটি সমন্বয়ে হচ্ছে ওয়াশ। একজন মানুষকে সুস্থ থাকতে দিন দিন এই খরচগুলো বাড়ছেই। ২০২০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তৈরি করা ওয়াস প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বছরে একজন মানুষের পানি স্যানিটেশন ও হাইজিনে খরচ হচ্ছে ৩৪৯১ টাকা। গড়ে একটি পরিবারের খরচ হচ্ছে ১১ হাজার ৫৭৪ টাকা। যা ওই পরিবারের মোট আয়ের ৪.৩ শতাংশ। বছরে জিডিপির ২.১৮ শতাংশ এই ওয়াশে খরচ হচ্ছে।

ন্যাশনাল ওয়াশ একাউন্ট প্রকাশনায় দেখা যায়, একজন মানুষের বছরে স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিনে খরচ হয় দুই হাজার ৯৩ টাকা, পানির পেছনে খরচ হয় ৫০০ টাকা এবং স্যানিটেশনে খরচ হয় ৮৯৮ টাকা, যা খুবই বেশি। মোট ওয়াশ খরচের প্রায় ৬০ শতাংশ স্বাস্থ্যবিধিতে এরপরে ২৬ শতাংশ স্যানিটেশনে ব্যয় হয়। মোট ওয়াশ খরচের ১৪ শতাংশ ব্যয় হয় পানীয় জলের জন্য।

প্রকাশনায় দেখা যায়, বছরে গড়ে প্রতিটি পরিবারের পানি বাবদ এক হাজার ৫০২ টাকা, স্যানিটেশন বাবদ এক হাজার ৯৮৫ টাকা এবং স্বাস্থ্যবিধি বাবদ ৮ হাজার ৮৭ টাকা খরচ করে। পরিবার প্রতি ওয়াশ বাবদ গড় খরচ ১১ হাজার ৫৭৪ টাকা যা তাদের বার্ষিক পারিবারিক আয়ের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আয়ের পরিমাণ অনুসারে পারিবারিক ওয়াশ ব্যয়ের বিভাজন থেকে দেখা যায়, শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ উভয় ক্ষেত্রেই দরিদ্র এবং দরিদ্রতম আয়ের পরিবারসমূহ তাদের আয়ের বড় অংশ ওয়াশে ব্যয় করে।

বাংলাদেশের মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ জনসংখ্যার নিরাপদ পানীয় জলের সুবিধা বঞ্চিত। জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ খাবার পানি সংগ্রহের জন্য নলকূপ ব্যবহার করে। আনুমানিক ১০ শতাংশ জনসংখ্যার ট্যাপ বা পাইপযুক্ত পানীয় জলে সুবিধা রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই শহরে বসবাস করেন।শহরে বসবাসকারীদের বেশিরভাগই বড় নেটওয়ার্ক সিস্টেমের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানির উপর নির্ভর করে। ২০২০ সালে শহর এলাকায় বসবাসকারীদের ওয়াশের ব্যয় ছিল ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। একই সময়ে, গ্রামীণ জনসংখ্যা এ খাতে ৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যেখানে ব্যয়ের ৭৯ শতাংশ ব্যবহৃত হয়েছে হস্ত বা মোটরচালিত পাম্প দিয়ে পানি তোলার জন্য।

এদিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯৯ শতাংশ ফ্ল্যাশ-পউর ফ্লাশ বা পিট ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। পিট ল্যাট্রিন ব্যবহারকারী এবং ফ্ল্যাশ-পউর ফ্লাশ ব্যবহারকারীর হার প্রায় একই, যা যথাক্রমে ৪৮ শতাংশ এবং ৫১ শতাংশ। ২০২০ সালে, মোট ওয়াশ বায়ের আনুমানিক ২৬ শতাংশ বা ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা স্যানিটেশন পরিষেবায় ব্যয় করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা গ্রামীণ এলাকায় এবং ৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা শহর এলাকায় ব্যয় করা হয়েছে।

স্বাস্থ্যবিধি ব্যয়

হাত ধোয়া এবং মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ব্যয় মোট স্বাস্থ্যবিধি ব্যয়ের ৯৬ শতাংশ। ২০২০ সালে, পরিচ্ছন্নতা পরিষেবার জন্য ব্যয় ছিল ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা, এরপর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির জন্য ১৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা খানাসমূহ সাবান এবং ডিটারজেন্ট সংগ্রহের জন্য মূলত ব্যয় করেছে।

বিভাগীয় পর্যায়ে ওয়াশ ব্যয়ের পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০২০ সালে ওয়াশ খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে ঢাকা বিভাগে (২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা), এরপরে চট্টগ্রামে (১৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা)। মোট ওয়াশ ব্যয়ের ১২ শতাংশ রাজশাহী বিভাগ ব্যয় করে থাকে। খুলনা, ময়মনসিংহ এবং রংপুরের ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় একই মাত্রার যা কিনা মোট ওয়াশ ব্যয়ের ৭.৪ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে। ওয়াশ ব্যয়ের সর্বনিম্ন অংশ সিলেট এবং বরিশাল বিভাগে পরিলক্ষিত হয়, যথাক্রমে ৪.৬ শতাংশ এবং ৩.১ শতাংশ।

২০২০ সালে বাংলাদেশের জন্য মাথাপিছু ওয়াশ ব্যয় ছিল ৩৪৯১ টাকা, যেখানে ঢাকার জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে জনপ্রতি ৪,২৯৫ টাকা, এরপরে চট্টগ্রাম ৩৯৯১ টাকা।

জানা গেছে, ২০২০ সালে মোট ওয়াশ ব্যয়ের প্রায় ১৬ শতাংশ কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক বা স্থানীয় সরকারের তহবিল দ্বারা অর্থায়ন করা হয়েছে। সরকারের মোট ৯ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার মধ্যে, কেন্দ্রীয় সরকার ৮ হাজার ৩০ কোটি টাকা এবং স্থানীয় সরকার ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা যোগান দেয়। ২০২০ সালে, ওয়াশ-সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোতে দ্বিপাক্ষিক সংস্থাগুলোর সরাসরি ব্যয় ছিল ১৩০ কোটি টাকা।

উল্লেখ্য, ন্যাশনাল ওয়াশ অ্যাকাউন্টস হলো একটি স্বীকৃত পদ্ধতি, যা জাতীয় পর্যায়ে পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি (ওয়াশ) সম্পর্কিত সরকারি এবং বেসরকারি ব্যয় ট্র্যাকিং করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য হলো, ওয়াশ পরিষেবাগুলোতে করা বিনিয়োগ ও খরচের একটি বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা এবং এসব পরিষেবা উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রমাণ-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এ তথ্যগুলো ব্যবহার করা। ন্যাশনাল ওয়াশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য সরকার এবং অন্যান্য অংশীজনদের বিনিয়োগের ব্যবধান চিহ্নিতকরণ, অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যয়খাত নির্ধারণ এবং টেকসই ওয়াশ পরিষেবা নিশ্চিত করতে কার্যকরভাবে এবং দক্ষতার সাথে সম্পদ বরাদ্দ নিশ্চিতে সহায়তা করতে পারে।